Wednesday, November 23, 2016

কালীঘাট পটের কথা


        
                                                                                               তীর্থক্ষত্র হিসাবে যেমন কালীঘাটের খ্যাতি যেমন সর্বত্র তেমনি কালিঘাটের পট সর্বত্র সমাদৃত এবং দেশ বিদেশে তার শিল্পগুনের জন্য সুপরিচিতকালীঘাটের পটের শিল্পশৈলী অভিনব কৌতূহলদ্দীপকউনিশ শত্কে কোলকাতায় তিনটি উন্নতমানের চিত্র্পদ্ধতি ছিল​- ()কালীঘাট পটচিত্র
                       ()বটতলার ছবি বা পাটাচিত্র
                       ()কোম্পানি চিত্রপদ্ধতি                                         
                                                     
                                                                                       
কালীঘাটে পটচিত্রের রমরমা ১৯ শতকে বেশী ছিল​.তবে এর উদ্ভব ঠিক কবে হযেছিল বলা যায়নাশিল্পী মুকুল দে ও অন্যান্য আলোচকদের ধারণা এই শতকের গোড়ায় বা তার কিছু আগে কালীঘাটের পটের উদ্ভব হয়েছিল​।কালীঘাটের পট চৌকো প্রকৃতির।কেউ কেউ মনে করেন চৌকো পটের জন্ম ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এবং তা বিস্তৃত হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক শোভন সোম এর মতানুযায়ী কলকাতায় কোম্পানী চিত্রকলার(উদ্ভব ১৭৭৪খ্রিস্টাব্দে) সঙ্গে সমান্তরালভাবে কালীঘাটেও পটচর্চা চলেছিল,তবে কালীঘাটের পটের সূচনা বহু আগেই হয়েছিল এক্ষেত্রে প্রামান্য যুক্তি হল এরকম-ভারতের প্রায় সকল মন্দিরে যেমন কাশীর বিশ্বনাথ,পুরীর জগন্নাথদেবে মন্দিরে,কন্যাকুমারিকা ,তাঞ্জোরে প্রভৃতি মন্দির সংলগ্ন বাজারের মত কালীঘাটের মন্দির বাজার যেখানে পটচিত্র বেশ কম দামে সহজলভ্য ছিল্,এখান থেকে সস্তা দামে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তরা ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ ছবি কিনে নিয়ে যেতেন।কালীঘাটের পট যখন আঁকা হয়েছিল তখন এদেশের ত​ৎকালীন ভদ্র শিল্প রসিকেরা পটের রস উপভোগ করেনি এমনকি পটশিল্পকে বাঙালী নিম্নমানের চিত্ররূপে অবহেলা করত।তখন ধর্মীয় ও লোকায়ত দুধরনের পটই পাওয়া যেত।অবশ্য অবনীন্দ্রনাথ,কুমারস্বামী,হ্যাভেল,রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি মনীষীরা ব্যতিক্রম ছিলেন।


কালীঘাট পটশৈলী রেখাঙ্কনে,বর্ণপ্রয়োগে,রূপবিন্যাসে স্বতন্ত্র ,প্রাচীনতা ও নবীনতার মেলবন্ধন ঘটেছে।মুক্ত উদারতার সঙ্গে কিউবিস্টিক,রিয়ালিস্টিক,ইম্প্রেশানিস্টিক ইত্যাদি শিল্পরীতিসুলভ বৈশিষ্ট্য খুব কম শিল্পধারাতে  চোখে পরে.কালীঘাট পটে তা বর্তমান্।
কালীঘাটের পটে যে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হত তা লৌকিক ধর্মেরই প্রতিচ্ছবিলক্ষী,সরস্বতী,কালী,দূর্গা,রামলীলা,কৃষ্ণলীলা নিয়ে কালীঘাটের পটুয়ারা যে ছবি আঁকতেন তা অনেক বেশী মানবিক করে আঁকা হত যেমন পায়ে বুট পরা রাবণ হনুমানের সাথে যুদ্ধ করছেন ,হনুমানও চড়- লাথি- গুঁতো মারছেন আবার দেবী ষষ্ঠী বাঙালী ঘরের বধূর মত,পারিপার্শ্বিকের ছোঁয়া ছিল আকারে পোশাকে পরিচ্ছদে

কালীঘাটের শিল্পীদের তৎকালীন সামাজিক ঘটনার সমালোচক-শিল্পী বলা চলেসামাজিক পটের অধিকাংশই আঁকা হযেছিল ১৮৬০-১৯০০ এর মধ্যেপ্রাচীন পরম্পরাকে সাথে রেখে নতুন পরম্পরায় এঁরা ছবি আঁকতেন,এই রীতি ভারতের অন্যন্য তীর্থস্থানের শিল্পীদের মধ্যে দেখা যায়নাপুরী,তাঞ্জোর ইত্যাদি তীর্থক্ষেত্রে অঙ্কিত চিত্র পরম্পরাগত,শৈলীও গতানুগতিক  কিন্তু কালীঘাটের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকমকালীঘাটের ধর্মনিরপেক্ষ পটচিত্রগুলি ১৯ শতকে "বাবু" সমাজের চিত্র উপহার দিয়েছে

কালীঘাটের লোকায়ত পটচিত্রগুলিতে উচ্চতর সমাজের উজ্জ্বল ছবি ফুটিয়ে তোলা হতসে সম যেসকল বাঙালীরা অর্থবান প্রতিপত্তিশালী ছিলেন তারা কেউ ছিলেন সরকার্,মুৎসুদ্দী,দেওয়ান বা চাকুরে ছিলেনএঁরা বাবু সম্প্রদাযের আদি পুরুষ,চূড়ান্ত বিলাসিতায় জীবন কাটাতেন,উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত "বাবু" দের চেহারা বিচিত্র!নক্সা করা কোর্তা,ধুতি লম্বা কোঁচা,টানা টানা লম্বা চোখ্,নাগরাই জুতো,বাবরি চুল ইত্যাদিবাবুদের সাথে বিবিদের ছবিও দেখা গেছিল​,এমনকি বারবনিতারাও ছিল এসব পটচিত্রে;গোলাপ হাতে গোলাপ সুন্দরী,আলবোলা হাতে তামাকসেবিনীকেউ আবার প্রসাধনরতা ;কেউ বীণাবাদনরতা;কেউ ফিরিঙ্গি কেতায় অভ্যস্ত,আসলে সবটাই বিদ্রুপরস মাখানো কিন্তু ব্যাঙ্গচিত্র উপভোগ্যঅবশ্য কিছু উচ্চস্তরের রমণী মূর্তি আঁকা হয়েছেএই বিদ্রুপের জ্বালায় বা হয়ত পটের মর্যাদাহানীকর স্বল্পমূল্যের জন্য সম্পন্ন গৃহস্থরা সাজসজ্জার উপকরণ থেকে কালীঘাটের পটকে বর্জন করেছিলেনকালীঘাট শৈলী আজ জীবিত না হলেও অনুভবে আসে,তৎকালীন মানুষের ধর্মীয় আকর্ষণ,সামাজিক রুচি স্প্ষ্ট হয়পটশিল্প যামিনী রায়ের মত শিল্পীর চিন্তায়,কর্মে প্রভাব ফেলেছিল,এই ঐতিহ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়
কালীঘাট পটে অঙ্কিত বাবু ও বিবি

No comments:

Post a Comment